New Posts

তাফসির আয়াত সূরা নাহাল 68/69 / মৌমাছির কাহানি

 


(وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ * ثُمَّ كُلِي مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلاً يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِلنَّاسِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ)


(আর দেখো তোমার রব মৌমাছিদেরকে একথাঅহীর মাধ্যমে বলে দিয়েছেন তোমরা পাহাড়-পর্বত, গাছপালা ও মাচার ওপর ছড়ানো লতাগুল্মে নিজেদের চাক নির্মাণ করো)

যখন আমরা এই আয়াত টি অধ্যয়ন করি তথন আমাদের ভাবতে অবাক লাগে কেনো আল্লাহতালা মৌমাছির নাম নিয়ে এই সুরাটি নাজিল করেন। মৌমাছি এ সূরার আলোচ্য বিষয় নয়। আল্লাহতালা মৌমাছি সমন্ধে এই আয়াত টি নাজিল করেন এমন কি সিফাত ও গুনাবলী আছে মৌমাছির মধ্যে যে আল্লাহতালা মৌমাছি সমন্ধে এই আয়াত টি তার নাম উল্লেখ করে অবতরণ করেন । আল্লাহর রাসূল তিনি বলেন, মুমিনরা হলো মৌমাছির মতো। এমন কি আছে মৌমাছির মধ্যে যে মুমিনে কে মৌমাছির মত বলেন আল্লাহর রাসূল।

মানে ভাবতে অবাক লাগে রসুল (সা.) কেন তার মুমিন মোত্তাকি উম্মতদের মৌমাছির সঙ্গে তুলনা করলেন।আল্লাহর লক্ষকোটি মাখলুকাতের মধ্যে মৌমাছি হলো ক্ষুদ্রতর অথচ তাৎপর্যপূর্ণ একটি পতঙ্গ গোষ্ঠী। সৃষ্টির আদি থেকেই মৌমাছিরা ছিল এবং মানুষজন তাদের দেখে আসছে। কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক বান্দা-বান্দী এই সৃষ্টিটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে ভেবেছে। প্রকৃতিতে মৌমাছির প্রজাতি রয়েছে ২০ হাজারেরও অধিক।এর মধ্যে মাত্র সাত-আটটি প্রজাতি মধু সংগ্রহ করে।

আমরা যদি গবেষণা করে দেখি তাহলে বুঝতে পারব যে এখানে আল্লাহ একটি মৌমাছি নয় বরং একজন মোমিনের সিফাত ও গুনাবলী বলছেন ।

আমরা জানি যে একটি মৌমাছি 50 থেক 60 জিবন পায়।

1973 সালে ~Von Frisch~মৌমাছির আচরণ ও যোগাযোগের উপর গবেষণার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

একটি মৌমাছির চারটি পাখা থাকে। কিন্তু তারা ওড়াউড়ির সময় দ্রুতগতিতে পাখা নাড়ায়। প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২০০ বার।তার মানে প্রতি মিনিটে 12000 বার তারা তাদের পাখা নাড়ায়।

এক একটি চাকে প্রায় ২০ থেকে ৬০ হাজার কর্মী মৌমাছি এবং একটি রানী মৌমাছি থাকে, এক একটা মৌচাকে প্রায় ১০০’র মত পুরুষ মৌমাছি থাকে।

Honey bees have three castes: drones, workers, and queens

আকার ও কাজের ভিত্তিতে মৌমাছিরা তিন সম্প্রদায়ে বিভক্ত:

যেমন:

১৷ রাণী মৌমাছি যা একমাত্র উর্বর মৌমাছি।

২৷ ড্রোন বা পুরুষ মৌমাছি।

৩৷ কর্মী মৌমাছি বা বন্ধ্যা মৌমাছি।

প্রত্যেকটি মৌচাকে মৌমাছিরা বসতিবদ্ধ হয়ে একটি বড় পরিবার বা সমাজ গড়ে বাস করে ৷ যেমন একজন মুমিন সমাজবদ্ধ ছাড়া সে তার জিবন অতি বাহিত করতে পারে না।

পরূষ মৌমাছিরা এরা কোনো কাজ করে না। সারাদিন কুঠরির মধ্যে থাকে। এরা নিজেরা খাবারটুকু পর্যন্ত খায় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত নারীরা এসে তাদের খাইয়ে দিয়ে যায়।

পুরুষ মৌমাছিরা তারা তাদের জীবন বেকারত্বের সাথে জিবন কাটায় কিন্তু তাদের জীবনেরও একটা লক্ষ্য আছে। এদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হল রাণী মৌমাছির সাথে মিলন।

আমি আগেই বলেছি যে এক একটা মৌচাকে প্রায় ১০০’র মত পুরুষ মৌমাছি থাকে। মিলন মৌসুমের প্রতিদিন দুপুরবেলা কোন এলাকার সকল মৌচাকের সকল পুরুষ (সাবালক) সদস্য এলাকার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ভিড় জমায়, যাকে বলে “পুরুষ ধর্মসভা এলাকা (drone congregation area)”, এর অবস্থান মাটি হতে ১৫-৪০ মিটার উপরে।

অন্যদিকে কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে প্রতিটা মৌচাক থেকে সাবালিকা (৭ দিন মৌমাছি) রাণী মৌমাছি ঘুরতে বের হয়, যেটা বিজ্ঞান বলে The Mating Flight এরপর উড়তে উড়তে রাণী মৌমাছি হটাৎ! করেই ঢুকে পড়ে পুরুষ ধর্মসভা এলাকায় কিভাবে রাণী এ এলাকা খুঁজে পায়, সেটা একটা রহস্য সে এসেই এক বিশেষ ধরনের গন্ধ (ফেরোমেনন) ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে শত শত পুরুষ মৌমাছি’রা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এবং এরপরই উড়ন্ত অবস্থায় রাণী মৌমাছি পছন্দমত পুরুষের সাথে মিলন করে। পর্যায়ক্রমে ১৮-২০ টা পুরুষ মৌমাছির সাথে মিলন হয় রাণীর।

তাহলে বাকি পুরুষগুলোর কি ভাগ্য খারাপ? অদ্ভুত ব্যাপার হল একটা পুরুষ মৌমাছির মিলনের সময়ে তার এন্ডোফেলাস (যৌনাঙ্গ) কর্মী মৌমাছির হুলের মতই ভেঙ্গে যায় এবং তখনই মারা যায় পুরুষ মৌমাছি। এ জন্য এ মিলন’কে বলে “The Dramatic Sexual Suicide”। বাকি পুরুষ মৌমাছি গুলো পরদিন আবার ধর্মসভা বসায়, অপেক্ষা করে জীবনের লক্ষ্য পুরণের; নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তারা এ কাজে আত্ম-ত্যাগ করে বংশ টিকিয়ে রাখার জন্য। আসলে সকল প্রাণীই তার বংশ রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করে যায়।

বেশ কিছু পুরুষ মৌমাছি মিলন হতে বঞ্চিত থেকে যায়, বংশরক্ষায় অংশ নিতে পারে না। কারণ তুলনামূলকভাবে পুরুষ মৌমাছি বেশি ( রাণী প্রতি মৌচাকে মাত্র ১টা, পুরুষ ১০০ টা)। মিলন বঞ্চিত হলেও তারা লাইফ সার্টিফিকেট পেয়ে যায়, বেঁচে থাকে শীত মৌসুম পর্যন্ত, মৌচাকের কাঁধের বোঝা হয়ে। শীতে খাবারের টান পড়লে কর্মী মৌমাছি’রা দূর করে দেয় এদের, মৌচাক হতে বনবাসে পাঠানো হয় তাদের। এবং সেখানেই ২-১ দিনের ভেতরে মারা যায়। নির্দয়ের মত একাজটা করে কর্মীরা শুধুমাত্র তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যেই।

উল্লেখ্য যে, রাণী মৌমাছি কিন্তু জীবনে এই একবারই মিলন করে। মিলনের ৩য় দিন থেকে বাকি জীবন (২-৫ বছর) সে এই মিলনের ফসলই ফলায় প্রতিদিন ১৫০০-২৫০০ ডিম পেড়ে। জীবনের শেষে তার পাড়া ডিমের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩-৪ মিলিয়ন। এভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মৌচাকের বিস্তৃতি।

শীতকালে রাণী ডিম পাড়ে না, কেননা তখন শীতের প্রকোপে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে। গ্রীষ্মে পুরোদমে ডিম পাড়ে রাণী। বেশি ডিম পাড়ার ফলে তখন অন্য একটি সমস্যা দেখা দেয়। বেশি ডিমের সাথে সাথে বেশি মৌমাছি, সাথে সাথে গ্যাঞ্জামও বাড়ে মৌচাকও বড় হতে থাকে। বেশি গ্যাঞ্জামের মধ্যে মৌচাকে নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ও স্বাভাবিক আচরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় নতুন মৌচাকের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কলুর বলদ কর্মী মৌমাছিরা এই প্রয়োজনের কথা জানতে পাড়ে কিভাবে?

আসলে রাণী মৌমাছি সবসময়ে বিশেষ ধরনের ফেরোমেনন ছড়ায়, কর্মীরা এর মাধ্যমেই রাণীর উপস্থিতি টের পায়। কিন্তু মৌচাক বেশি বড় হয়ে গেলে রাণীর ফেরোমেনন সকল কর্মী পর্যন্ত পৌঁছায় না। তখন দূরে থাকা কর্মীরা ধরে নেয়, তাদের রানী আর নেই। তাই কর্মী মৌমাছিরা তখন নতুন রাণী মৌমাছি বানানোর জন্য বিশেষভাবে তৈরি কুঠুরী (cell) বানায়। রাণী মৌমাছি এই বিশেষভাবে বানানো কুঠুরিতে নিষিক্ত ডিম পাড়ে।

কর্মী মৌমাছিরা এই বিশেষ ডিম গুলো থেকে বেরোনো লার্ভাদের জন্মের পর থেকেই পূর্ণ-বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত এক বিশেষ ধরনের তরল খাওয়ায় – যার নাম রয়েল জেলী। এই রয়েল জেলী দুধের ন্যায় সাদা বস্তু, যা উৎপন্ন হয় কর্মী মৌমাছির মাথা’র মগজ থেকে। এই রয়েল জেলী শুধু যে মৌমাছির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা নয়, মানব জীবনে অন্যান্য প্রাণীর জীবনেও মৌমাছির রয়েল জেলী’র বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, নিষিক্ত ডিম হতে উৎপন্ন কর্মী মৌমাছি’দেরও রয়েল জেলী খাওয়ানো হয়; তবে খাওয়ানো হয় মাত্র ৩ দিন। এরপর তাদের স্বাভাবিক খাবারই (মধু,রেনু ইত্যাদি) খাওয়ানো হয়।

অনাকাঙ্খিত কারণেও যদি কোন রাণী মৌমাছি মারা যায়, তবে ১৫ মিনিটের মধ্যে সকল কর্মী মৌমাছি সে খবর পেয়ে যায়। এবং স্বপ্রণোদিতভাবে নতুন রাণী মৌমাছি বানানোর উদ্যোগ নেয়।

যাই হোক রয়েল জেলী খেয়ে খেয়ে রাজকীয় ভাবে বেড়ে ওঠে আগামী দিনের সম্ভাব্য রাণী। অন্যদিকে নতুন রাণী কে জায়গা ছেড়ে দিতে পুরনো রাণী বেশ কিছু কর্মী মৌমাছি সাথে করে মৌচাক ছেড়ে চলে যায়। কারণ, একটা মৌচাকে একটাই রাণী থাকতে পারে।

পুরনো রাণী এরপর কোথায় যায়? সে তার দল-বল সহ নতুন মৌচাক এর জন্য খোঁজ করতে থাকে। রাণী মৌমাছি’র যাতে কোন ক্ষতি হতে না পারে, সে জন্য সকল কর্মী মৌমাছি মিলে তাকে ঘিরে রাখে। এই দৃশ্য হয়ত আমরা অনেকেই দেখেছি। তারা কোন গাছের ডালে আশ্রয় নেয়। খোঁজার জন্য দলের কিছু কর্মী স্কাউট হিসেবে ঘুড়ে বেড়ায়। এবং ভাল কোন জায়গা পেলে এসে খবর দেয়। তারপর সকলে মিলে নতুন জায়গায় আবার শুরু করে নতুন জীবন। আবার শুরু হয় নতুন করে মৌচাক তৈরি, জন্মায় নতুন নতুন পুরুষ, কর্মী মৌমাছি।

অন্যদিকে আগের মৌচাকে নতুন রাণী মৌমাছি ৮ দিনের মাথায় বেরিয়ে আসে কুঠুরি (cell) থেকে। সকলেই এভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে ওঠে।

এরপর নতুন রাণী মৌমাছি হয়ত কিছু কর্মীকে সঙ্গে করে নতুন কোন উপযুক্ত জায়গার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে, যেখানে নতুন মৌচাক বানানো যায়। অথবা, আগের মৌচাকেই থাকে, কিন্তু কিছু বিশেষ ডিম, লার্ভা (যেগুলোর ভবিষ্যতে রানী হওয়ার কথা) ধংস করে দেয়। যাতে নতুন কেউ রাণী হতে না পারে।

প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নতুন মৌমাছি বের হয় জীবনের প্রথম এবং হয়ত শেষ মিলন এর জন্য, অসংখ্য পুরুষ মৌমাছির ভাগ্য নির্ধারণ করতে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বীজ ধারণ করতে। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।

আমেরিকান গবেষণায় দেখা যায়, মৌমাছির পরাগায়নের কারণে শুধু আমেরিকাতেই প্রতি বছর ৩২ বিলিয়ন ডলার মুল্যের ফসল বেশি ফলে।

মৌমাছির শীত মৌসুম টিকে থাকার জন্যই মূলত মধু তৈরি করে। তবে বেশি সিরিয়াস বলে এরা প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন মধু তৈরি করে।

﴿ ثُمَّ كُلِىۡ مِنۡ كُلِّ الثَّمَرٰتِ فَاسۡلُكِىۡ سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلاً‌ؕ يَخۡرُجُ مِنۡۢ بُطُوۡنِهَا شَرَابٌ مُّخۡتَلِفٌ اَلۡوٰنُهٗ فِيۡهِ شِفَآءٌ لِّلنَّاسِ‌ؕ اِنَّ فِىۡ ذٰلِكَ لَاَيَةً لِّقَوۡمٍ يَّتَفَكَّرُوۡنَ﴾





(তারপর সব রকমের ফলের রস চোসো এবং নিজের রবের তৈরি করা পথে চলতে থাকো।এ মাছির ভেতর থেকে একটি বিচিত্র রংগের শরবত বের হয়, যার মধ্যে রয়েছে নিরাময় মানুষের জন্য।৫৮ অবশ্যি এর মধ্যেও একটি নিশানী রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তা-ভাবনা করে)

এখানে আল্লাহতালা সরবত বলতে মধু কে বুঝিয়েছেন।

মৌমাছির ১৭০টি ঘ্রাণ সংবেদী ইন্দ্রিয় আছে, যার দ্বারা এরা অনেক দূর থেকেও নির্দিষ্ট ফুলের ঘ্রাণ পায়।

মাত্র এক চা চামচ মধু সংগ্রহ করতে মৌমাছির কয়েক হাজার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে হয়।

৫০০ গ্রাম মধু তৈরী করতে মৌমাছির ২ মিলিয়ন ফুলের দরকার

মৌমাছি প্রতি ঘন্টায় ৮ কিলোমিটার উড়তে পারে

পৃথিবীতে মধু হল একমাত্র খাদ্য যা কখনো পচে না।

মধু যে একটি উপকারী ও সুস্বাদু খাদ্য তা কারোর অজানা নেই।

মুমিন ও মৌমাছির সম্পর্ক

এক

মৌমাছিরা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে এবং সবসময় নেতার আদেশ-নির্দেশ মেনে চলে। তারা সীমা অতিক্রম করে না। তারা কখনো নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে না এবং আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত অন্যকে আক্রমণ করে না। তদ্রূপ রসুল (সা.)-এর মুমিন উম্মতরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে নবীকে তাদের প্রকৃত নেতা মানে এবং তার জীবনাদর্শকে পুঁজি করে জীবিকা নির্বাহ করে। আল্লাহর দেওয়া বিধানের দ্বারা নিজেদের জীবন-জীবিকা-কর্ম এবং চিন্তার সীমা নির্ধারণ করে নেয় এবং নিজেরা কোনো দিন সেই সীমা অতিক্রম করে না। মুমিনরা আল্লাহ এবং তাঁর রসুল (সা.)-এর দিকে তাকিয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে না- তদ্রূপ আক্রান্ত না হলে কাউকে আক্রমণ করে না- এমনকি অপ্রয়োজনে একটি গাছের পাতাও ছিঁড়ে না।

দুই

মৌমাছি বিনা কারণে এলোমেলোভাবে ওড়ে না। তারা বহুদূর থেকে ফুলের গন্ধ অনুভব করতে পারে। সেই গন্ধ অনুসরণ করে তারা প্রায় দুই মাইল পথ অতিক্রম করে কাঙ্ক্ষিত ফুলের ওপর গিয়ে বসে। ফুলের ওপর বসতে গিয়ে তারা প্রথমে বিবেচনা করে যে তারা যদি ফুলের ওপর বসে, তবে ফুলটির কোনো অসুবিধা হবে না। এরপর তারা লক্ষ্য করে ফুলের মধুর পরিমাণ ও অবস্থা। তারা শুধু ফুল থেকে ততটুকু মধুই গ্রহণ করবে যতটুকু গ্রহণ করলে ফুলের পরাগায়ন-গর্ভধারণ এবং ফল ফলাতে কোনো অসুবিধা হবে না। এর ব্যতিক্রম হলে মৌমাছিরা ফুলের চারদিকে শুধু ওড়ে কিন্তু বসে না- আবার বসলেও মধু সংগ্রহ না করে অন্য ফুলের কাছে চলে যায়।

রসুল (সা.)-এর মুমিন উম্মতরা এমনভাবে রিজিক অর্জন করে যাতে করে অন্য কোনো বান্দার ক্ষতি হয় না। তারা রিজিকের জন্য জমিনে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের জন্য নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যায়। তাদের ব্যবসা, বাণিজ্য, কর্ম- সব কিছুই পরিচালিত হয় আল্লাহর হুকুম, রসুল (সা.)-এর হাদিস এবং নিজেদের অন্তর্নিহিত সুবিবেচনার দ্বারা। যেসব স্থানে ইমান-একিন নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থাকে সেসব বাজারে মুমিনরা গমন করেন না। মৌমাছিদের মতো তারাও তাদের গন্তব্য ঠিক না করে ঘর থেকে বের হন না।

তিন

মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করার পর তা নিজেদের সম্পদ মনে করে না। তারা রানীর হুকুমকে হৃদয়ে ধারণ করে মুখের মধ্যে মধু এমনভাবে সংরক্ষণ করে, যাতে এক বিন্দু মধুও তাদের পাকস্থলীতে না যায়। বরং যাত্রাপথের ক্লান্তি এবং নিজেদের ইন্দ্রিয়ের চাপে মুখ থেকে লালা নিঃসরিত হয়ে মধুর সঙ্গে মিশে যায়, যা কিনা মধুর গুণাগুণকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। মৌচাকে ফিরে মৌমাছিরা সেই লালাসমেত মধু মৌ কুঠরির পাহারাদারকে সাক্ষী রেখে কুঠরির মধ্যে সমর্পণ করে। পুরোটা সময় তারা একজন উত্তম আমানতকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। মুমিন উম্মতরা প্রথমত আমানতের খেয়ানত করে না। তাদের উপার্জিত রিজিককে তারা মনে করে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত এবং আমানত, যা কিনা ব্যয় হবে পবিত্র উপায়ে কেবল পরিবার পরিজন আত্দীয়-স্বজন এবং আল্লাহর দীনের খেদমতে। নিজের খামখেয়ালি, বিলাস-ব্যসন কিংবা শয়তানী মত ও পথে কোনো মুমিন তার রিজিক ব্যয় করে না। এখানে রিজিক বলতে বুঝতে হবে- অর্থকড়ি, পদ-পদবি, ক্ষমতা, জৌলুস, প্রভাব প্রতিপত্তি, সন্তান-সন্ততি, শক্তি-সামর্থ্য এবং জ্ঞান-বুদ্ধি প্রজ্ঞাকে।

চার

মৌমাছিরা ফুলের কাছে গমন করে। মধুময় ফুলের কাছে উপস্থিত হয়ে আনন্দে আত্দহারা হয়ে তারা প্রথমে ফুলের সেবা করে। ফুলের পরাগায়ন ঘটায়। গান গেয়ে ফুলের ওপর নাচানাচি করে এবং নিজেদের পাখার ঝাপটায় ফুলের মধ্যে সঞ্চারিত প্রাণকে উজ্জীবিত করে তোলে এবং সবশেষে মধু আহরণ করে ফিরে যায় আপন আলয়ে। রসুল (সা.)-এর উম্মতরা সর্বদা তাদের রিজিকের উৎসের প্রতি কায়মনো বাক্যে কৃতজ্ঞ থাকে। রিজিকের উৎস যাতে বৃদ্ধি পায় তারা সর্বদা সেই চেষ্টা করে। তারা কোনোদিন নিজেদের রিজিক সংগ্রহ করতে গিয়ে রিজিকের উৎসমূল ধ্বংস করে না।

পাঁচ

মৌমাছিদের সব কর্ম আবর্তিত হয় মৌচাককে কেন্দ্র করে। তারা রাগ বা অভিমান করে মৌচাক ছিঁড়ে গাছের ডালে বা কোনো ফুল-পাতায় রাত কাটায় না। তারা একজন অন্যজনকে হিংসা করে না। কেউ কারও ওপর প্রাধান্য দেখায় না। অন্যের হক নষ্ট করে না। মৌচাকের অলস এবং দুর্বল লোকদের খোটা দেয় না এবং কারণে অকারণে ঝগড়া করে না। তারা রানীর আইন-হুকুম আহকাম মেনে চলে। তারা চলার পথে গুনগুন শব্দে জিকির করে এবং গন্তব্যে যাওয়ার পথে আশপাশে তাকিয়ে ফন্দি ফিকির করে না। তারা মাঝ পথে থেমে যায় না এবং মৌচাক ও নির্দিষ্ট ফুলের মাঝে অন্য কিছুতে আকৃষ্ট হয় না। তারা মৌচাকের বাইরে উন্মুক্ত প্রান্তরে কোনোদিন যৌন সঙ্গম করে না।

রসুল (সা.)-এর মুমিন উম্মতরা তাদের সব কর্ম পরিচালনা করে প্রথমত পরিবারকে কেন্দ্র করে। এরপর তারা তাদের মিল্লাত-সমাজ এবং রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। তারা বিনা প্রয়োজনে বাইরে রাত কাটায় না এবং অজায়গা বা কুজায়গায় গমন করে না। এক মুমিন অন্য মুমিনকে মহব্বত করে- পরস্পর বিবাদ করে না। তারা অসহায়কে সাহায্য করে, দুর্বলকে আশ্রয় দেয় এবং অভাবগ্রস্তকে দান

মোহাঃ মোস্তাক আহমেদ

 

No comments